ছোটবেলায় যখন পড়লাম বাংলাদেশের একটি টাকশাল আছে, গাজীপুরে, তখন ভাবতাম ওখানে টাকা ছাপালেই তো আমরা ধনী রাষ্ট্র হয়ে যাব, অনেককিছু করে ফেলা যাবে। সরকার প্রচুর টাকা ছাপিয়ে সবাইকে সেগুলো দিয়ে দিলেই পারে। সেই ভাবনাটা সত্যি হলে আমরা গাজীপুরে টাকা ছাপিয়ে পদ্মা সেতু বানিয়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু টাকা জিনিসটা এইভাবে কাজ করে না। ধরুন আপনি পদ্মাসেতু বানাবেন। এজন্য আপনার লাগবে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, শ্রম, বুদ্ধি। এখন, এর সবকিছু দেশে পাওয়া যায়না, দেশে উৎপাদনও সম্ভব না। এগুলো বিদেশ থেকে কিনতে হবে। এখন গাজীপুরে টাকা ছাপিয়ে সেই টাকা দিয়ে আপনি এগুলো কিনতে পারবেন না। কারণ দেশের বাইরে টাকার মূল্য নেই। এগুলো আপনাকে ডলার দিয়ে কিনতে হবে। এখন ডলার কোথায় পাবেন? আপনার হয়ে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক বিদেশি কোনো ব্যাঙ্ক থেকে ডলার কিনবে তখন। সেই ডলার কিসের বিনিময়ে কিনবে? টাকা তো তারা নিবে না। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক তাদেরকে স্বর্ণ দিবে। স্বর্ণের বিনিময়ে তারা সমতুল্য ডলার কিনবে। এখন এই স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক কোথায় পায়? বাংলাদেশ থেকে আমরা বিভিন্ন দ্রব্য, শ্রম ইত্যাদি বিদেশে বিক্রি করি। বিনিময়ে আমরা ডলার পাই, সেই ডলার তো দেশে চলে না। ফলে আমরা বাংলাদেশ ব্যাঙ্ককে ডলার দিয়ে সমতুল্য টাকা কিনি। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক সেই ডলারের কিছুটা লিকুইড রাখে, কিছুটা দিয়ে স্বর্ণ কিনে মজুদ করে। এটাকেই আমরা রিজার্ভ বলি। রিজার্ভ বাড়তে থাকার মানে হলো, আমরা বিদেশে বেশি বেশি জিনিস বিক্রি করে বিদেশের টাকা দেশে নিয়ে আসছি ও ভবিষ্যতের জন্য মজুদ করছি। তো, মূল ব্যাপারটা হলো টাকা, ডলার এসব হলো শো-অফ, এখনও পৃথিবীতে পুরাতন পণ-বিনিময় প্রথাই চলে। আমরা এক দ্রব্য দিয়ে আরেক দ্রব্য কিনি, স্বর্ণ কিনি। যাইহোক, ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়ালো, বাংলাদেশ সরকার নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু বানাচ্ছে, তার মানে এই না যে আমরা টাকশালে টাকা ছাপিয়ে তা বানাচ্ছি। এটা সম্ভবও না, তার কারণ উপরেই আছে। মুদ্রাস্ফীতি হয়ে যাবে ও অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। একটা সরকারের নিজের টাকা বলে আসলে কিছু থাকে না। সরকার প্রতিবছর একটা বাজেট ঘোষণা করে, সেখানে তার ব্যায়গুলো উল্লেখ থাকে, আয়গুলোও উল্লেখ থেকে। আয় থেকে ব্যয় বেশি হলে সেটা হলো বাজেট ঘাটতি, এইটা বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে আপাতভাবে পূরণ করে। তো, প্রতিবছরের বাজেটে পদ্মাসেতুর একটা আলাদা ব্যয় ধরা থাকে। সেই টাকা দিয়ে পদ্মাসেতুর একেকটা স্প্যান উঠে। এছাড়াও দেশিয় ইনভেস্টরের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়, অনেকটা ধারের মতো। এই দুইটা মিলে দেশিও অর্থায়নের বড় বড় প্রজেক্টে খরচ চালানো হয়(পদ্মাসেতুর ক্ষেত্রে ইনভেস্টর আছে কিনা শিওর না) Annual Development Programme(ADP) এর মাধ্যমে প্রতিবছরের জন্য নির্ধারিত ফান্ড সরকার থেকে পদ্মাসেতুর প্রজেক্টে পৌঁছায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার বাজেট ও অন্যান্যভাবে সংগৃহীত ৫৩.৭১ বিলিয়ন টাকা দিবে বলে ঠিক করেছিল। করোনা ইস্যুতে কাজ ধীরগতির হয়ে যাওয়ায় সরকার তা থেকে কমিয়ে ৪০.১৫ বিলিয়ন টাকা প্রজেক্টে দেয়। বাকি ১৩.৫৬ বিলিয়ন টাকা এই অর্থবছরে অন্য কোনো উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করে সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রদান করা ফান্ড এবছরের চেয়ে বেশি ছিল। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২১৫.৬৪ বিলিয়ন, যা টোটাল কস্ট এর ৭১%, এতদিনে হয়তো আরও বেশি। তো, এমন একটা সেতু চাইলেই সরকার এক বছরে করে ফেলতে পারে না, আপনার বাবা যেমন চাইলেই এক বছরে জমি কিনে ফেলতে পারে না। বছর বছর কয়েকটা কিস্তিতে ফান্ড ম্যানেজ করে সেই টাকায় পদ্মাসেতু প্রজেক্ট এর খরচ চালানো হয়। পুরোটাই একটা মহাজটিল প্রক্রিয়া। যাইহোক, সেতু তৈরি হয়ে গেলে তখন আসে RoI বা Return on Investment পলিসি। পদ্মাসেতু হলে জিডিপি বুস্ট করবে, সেখান থেকে রাষ্ট্র উন্নত হবে, মানুষ ধনী হবে, উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে রিজার্ভ বাড়বে, এগুলো ভিন্ন আলাপ। কিন্তু এই যে পদ্মাসেতুর জন্য সরকারের সমসাময়িক বাজেট ঘাটতি হলো, সেই ঘাটতি মেটাতে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে, রিজার্ভ থেকে ঋণ নিতে হলো সেটা ফেরত দিতে হবে না সরকারকে? এই টাকা কিভাবে ফেরত দিবে? আর ব্রিজ বানানো হয়ে গেলেও নদীশাসন চলতে থাকে, যেন নদী গতিপথ পরিবর্তন করে ব্রিজ ছেড়ে অন্যদিকে চলে না যায়। বছর বছর এই খরচ কোত্থেকে আসবে? এর খুবই সহজ সমাধান হলো টোল বসানো। টোলে সবাই একটু একটু করে টাকা দিতে থাকলে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেতু বানানোর খরচটা উঠে যায়। তখন বাংলাদেশ সরকার তার দেশের অভ্যন্তর থেকে নেওয়া ঋণগুলো ফেরত দিয়ে দিতে পারে। আর ঋণ ফেরত দিলে নতুন ঋণ নিতে পারবে, তখন পদ্মাসেতুর মতো আরও বড় বড় কাজে হাত দেওয়া যাবে। পাশাপাশি সরকার বা ব্যাঙ্ক থেকে যে এতগুলো টাকা খরচ হলো, সেই টাকাটা যদি আবার ফেরত আসে, তখন পদ্মাসেতুর মতো আরও প্রজেক্ট হাতে নেওয়া যায় সেই টাকাটা ইনভেস্ট করে। সুতরাং টোল দিতে কারোর আপত্তি হওয়ার কথা না। আমাদের নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু হচ্ছে, তার মানে এই না যে সরকার প্রচুর টাকা নিয়ে বসে আছে, টাকশালে টাকা ছাপিয়ে তা পুষিয়ে নিবে। এই পুরো জটিল প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ হলো টোল দেওয়া, অর্থনীতিটা সচল রাখা। টোল দেওয়া একটা বিরক্তিকর কাজ, থামতে হয়, নগদ ক্যাশ দিতে হয়, বিরক্তি আসাটাই স্বাভাবিক। এই বিরক্তির কারণে ফ্লোরিডার জ্যাকসিনভিলের জনগণ রিভল্ট করে। সেন্ট জন্স নদীর চারটা ব্রিজে বসানো টোল তাদের রিভল্টের কারণ। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তারা ভোট দিয়ে ঠিক করে ব্রিজ থেকে টোল উঠিয়ে দেওয়া হবে। বিনিময়ে তারা সবাই ০.৫% বিক্রয়-কর বেশি দিবে। অর্থাৎ তারা বাড়তি দাম দিয়ে পণ্য কিনবে, বাড়তি টাকাটা সরকার পাবে। মানে, সরকার ব্রিজ বানানোর খরচ টোল থেকে উঠানোর বদলে অভ্যন্তরীণ পণ্য-বাজার থেকে উঠাবে। ১৯৮৯ সালে ফাইনালি সেই চারটা ব্রিজ থেকে টোল উঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন নিজে টাকা দিয়ে যে পদ্মাসেতু বানাইতেসেন সেই টাকাটা কিভাবে দিবেন? টোলের মাধ্যমে? নাকি টোল উঠিয়ে দিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে? নাকি কর ফাঁকি না দিয়ে নিজেরা আরও বেশি কর পরিশোধ করে? একটা দেশের ১৪ বছর ধরে সর্বোচ করদাতা একজন জর্দা ব্যাবসায়ী, তার নাম কাউছ মিয়া। জর্দা বেঁচে একজন নাকি দেশে সবচেয়ে বেশি আয় করে, এটা আপনি আমি কেউই বিশ্বাস করিনা। জর্দা ব্যাবসায়ী সর্বোচ্চ করদাতা এর মানে হলো, হাজার হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিই আমরা প্রতিবছর। সবাই মিলে কর ফাঁকি দেওয়ার দেশে কর বাড়িয়ে, পণ্যের দাম বাড়িয়ে পদ্মাসেতুর খরচ উঠে যাবে? সম্ভব না। একমাত্র উপায় টোল বসিয়ে নগদ টাকা বের করে নিজেদের টাকায় বানানো পদ্মাসেতুর খরচ উঠানো। কর দিতে চান না, টোলও দিতে চান না, চান শুধু বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসম্মান হারিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের পায়ের তলায় পিষ্ট হতে? আর তাও না চাইলে টাকশালে টাকা ছাপিয়ে কাগজের পদ্মাসেতু বানানো ছাড়া তো উপায় দেখি না। লিখা : দীপ্ত আকাশ রয়